বাজরিগার পাখির ফেদার প্লাকিং

বাজরিগার পাখির ফেদার প্লাকিং – Budgie bird’s Feather Plucking

Post by

বাজরিগার পাখি হোক আর যে কোন পাখি হোক সব পাখি পালতেই একটি খুব পরিচিত এবং বিরক্তিকর অভিজ্ঞতা হচ্ছে  ফেদার প্লাকিং, এই সমস্যা টি সমাধান করার চেষ্টা করেনি এমন একজন বাজরিগার পাখির ব্রিডার খুঁজে পাওয়া কিছুটা কঠিন বলে মনে হয়। অনেক ছোট ছোট খুব সুন্দর কিছু পাখির বাচ্চা আসে এবং আপনার বুকে একটু আশা জাগে আর আপনি এই ছোট ছোট বাজরিগার পাখি গুলো বড় হওয়ার অপেক্ষা করতে থাকেন

তারপর হঠাৎ একদিন চোখের সামনে ভেসে আসে এই বেদনাদায়ক দৃশ্য। এটি একটি রোগ নাকি সমস্যা তা ঠিক মত বলা যায় না , কারণ এটি কোন ধরণের রোগ বা মানসিক সমস্যা না। এই রোগটিকে ডাক্তারি ভাষায় ট্রাইকোটিলোম্যানিয়া (TRICHOTILLOMANIA) বলা হয় – যার কারণে রোগীর শরীর এর পশম বা মাথার চুল এগুলো পড়ে যায়। মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যেও এই একই ধরণের রোগ প্রায়ই দেখা যায়।

যে যে পাখির ফেদার প্লাকিং(Feather Plucking) সমস্যা বেশি হয়ঃ

  • বাজরিগার (Budgie),
  • লাভ বার্ড(Love Bird),
  • ফিঞ্ছ পাখি(Finch Bird),
  • ককাটেল (Cocatel Bird)

বাজরিগার পাখির ক্ষেত্রে প্রায়ই ফেদার প্লাঙ্কিং এর মত সমস্যা বাচ্চা পাখিদের উপ্রদিয়ে যেতে দেখা যায় । এর অনেক কারণ রয়েছে, যেমন পরজীবী সংক্রমণ, অ্যালার্জি, একাকীত্ব এবং অসাড়তা, অতিরিক্ত যৌন হরমোন, লিভারের রোগ, অপুষ্টি, বাতাসে আর্দ্রতা, তাজা এবং পরিষ্কার বাতাসের অভাব, যৌন মিলনে সাহচর্যের অভাব, কখনও কখনও জেনেটিক কারনেও এই ধরণের সমস্যা হয়।

কিন্তু সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হল যে বেশিরভাগ সময়ই বাজরিগার বেলায় আপনি ফেদার প্লাঙ্কিং বা এই ধরণের সমস্যা বুজতে পারবেন না। তবে কিছু বিষয় মেনে চললে বাজরিগার পাখির ফেদার প্লাকিং এর হার অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব।

তো চলুন জানা যাক কি কি কারনে বাজরিগার পাখির ফেদার প্লাকিং এর মত মারাত্মক রোগ হতে পারে  এবং এর প্রাক-চিকিৎসা বা প্রস্তুতির ক্ষেত্রে আমরা কি কি ধরণের পদখহেপ নিতে পারি বা কি কি কাজ করতে পারি টা নিয়ে আজকে আলোচনা করা যাক।

বাজরিগার পাখির ফেদার প্লাকিং
বাজরিগার পাখির ফেদার প্লাকিং

১/ বাজরিগার পাখির পরজীবী এবং অ্যালার্জি:

যদি আপনার বাজরিগার পাখির গায়ে উকুন থাকে অথবা বিভিন্ন পরজীবী দ্বারা সংক্রামিত হয়, তখন তারা নিজেদের শরীর চুলকাতে থাকে আর আস্তে আস্তে শরীর এর পশম উঠানো শুরু করে দেয় । এই রকম ঘটনা যে খালি ফেদার প্লাঙ্কিং এর বেলায় ঘটে তা না বরং এটি অ্যালার্জির বেলায়ও ঘটতে পারে।

চিকিৎসা:

 আপনার পাখিকে পরজীবী অথবা অ্যালার্জির আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে, আপনি মাসে ১-২ বার নিম পাতার সিদ্ধ পানি দিয়ে পাখিকে গোসল করাতে পারেন আর চাইলে পাখির গায়ে এভিয়ারি স্প্রে করতে পারেন এবং একইভাবে সবগুল পাখিকে মাসে ১-২ বার রসুনের জল দিয়ে ভালো করে গোসলও করতে পারেন আবার চাইলে স্প্রেও করাতে পারেন। এছাড়াও মাসে ১ বার (acimec 1% oral solution) ঔষধ টি লিটারে ২ মিলি ব্যাবহার করে পাখিকে গোসল ও এভিয়ারি স্প্রে করতে পারেন।

২/ একঘেয়েমি বিসন্বতাঃ

বাজরিগার পাখি অথবা পাখির বাচ্চাদের জন্য একটি খুব বড় সমস্যা যা তাদের লার্ভা ভেঙে দেয়। এই সমস্যা বেশি দেখা যায় যদি পাখি দীর্ঘদিন ধরে সঙ্গী ছাড়া থাকে, আবার পাখি যদি  একই সঙ্গীর সাথে দীর্ঘকাল বসবাস করে, পাখিকে টানা ব্রিডিং করালে, পাখি রেস্টে থাকা অবস্থায় পর্যাপ্ত বিনোদন না পেলে সেক্ষেত্রে এই সমস্যাটি দেখা যায়।

সমাধান:

এই সমস্যা সমাধানের জন্য পাখিকে পর্যাপ্ত সময় পর্যন্ত বিশ্রাম দিন, পাখিকে তার সঙ্গী বেছে নেওয়ার সুযোগ দিন, মিউটেশন নিয়ে কাজ করার জন্য তাকে বারবার বিরক্ত করবেন না।

ডাইটে বৈচিত্র্য থাকা উচিত, বাজরিগার পাখি একই খাবার বার বার খাওয়ার ফলে বিরক্ত অথবা ক্লান্ত হয়ে যেতে পারে, তাই আপনি বীজের মিশ্রণে বিভিন্ন ধরণের ভুট্টা ব্যবহার করতে পারেন, একটি বড় ফ্লাইট উইন্ডো দিতে পারেন এবং কামান, কার্ব, ফটো এবং আরও অনেক কিছু থাকতে পারেন। জানালায় মজা। সিঁড়ি মত বিভিন্ন খেলা দিন।

৩/ বাজরিগার পাখির প্রজনন হরমোন:

বাজরিগার পাখির ফেদার প্লাকিং এর জন্য প্রধানত দায়ী হচ্ছে এই প্রজনন ও হরমোন। হাঁস-মুরগি থেকে শুরু করে গবাদি পশু- পাখি অতিরিক্ত উৎপাদনের জন্য হরমোনের প্রয়োজন হয় এবং আমরা প্রায়ই এর জন্য দায়ী থাকি।

প্রজননের আগে, অনেকেই পাখির উর্বরতা বাড়ানোর জন্য বাজরিগার পাখিকে বিভিন্ন ধরণের ওষুধ ব্যবহার করে। ফলস্বরূপ, বাচ্চা জন্মের আগে পাখি গুলো ভালো অবস্থায় থাকে এবং পাখি গুলো পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আরামদায়ক হয়। এবং এদের শিশুও তারাতারি বড় হয় তাই এদের তারাতারি আলাদা করা যায় ।

সমাধান:

পাখিকে কখনই ব্রিডিং ের জন্য বাধ্য করা যাবে না। জত সম্ভব পাখিকে অতিরিক্ত ঔষধ বা উপকরণ ব্যবহারের দিক থেকে এড়িয়ে চলতে হবে । যদি সম্ভব হয়, তাহলে ঔষধ ব্যাবহার সম্পূর্ণভাবে প্রস্থান করুন। আর হে হারিতে বাচ্চা থাকলে ,পাখিকে মাঝে মাঝে কিছু লবণ জল বা সেলাইন দিন।

বার বার হারি বের করা যাবে না, বাচ্চা নিজে খাওয়া না শিখা পর্যন্ত হারি থেকে নামিয়ে দিবেন না এতে পাখি বিরক্ত হয়ে বাচ্চার উপর হামলা করতে পারে, বাবা পাখিটি যাতে স্ট্রেসে চলে না আসে সেজন্য খাচায় একটি আয়না রাখতে পারেন, মা পাখি বাচ্চা খাওয়াতে যেয়ে যাতে বেশি বিরক্ত না হয় এজন্য বড় হারি দেয়া উত্তম শিশুদের প্রতিদিন নরম খাবার দিতে হবে।

৪/ অপুষ্টি:

 অপুষ্টিতে আক্রান্ত পাখিরা সাধারণত খালি চোখে দেখতে পায় না। যদি পাখিরা দুর্বল বা অপুষ্টিতে ভোগে তাহলে এই ভগান্তি তাদের বাচ্চাদের ও ভুগতে হবে। শরীরে ক্যালসিয়াম, জিঙ্ক ও মিনারেলের অভাব হলে চুল শুষ্ক হয়ে যায়, চুলের গোড়া শুষ্ক ও ফাটল ধরে। ক্যালসিয়াম এবং জিঙ্কের ঘাটতি পূরণ করার জন্য যখন পাখি নিজেকে খাওয়ায় বা তার নিজের পালক বা ছানা ফেলে দেয় তখন এটি হয়। এই সমস্যাটি প্রজনন মৌসুমে সবচেয়ে স্পষ্টভাবে দেখা যায় কারণ প্রজনন মৌসুমে পাখিরা প্রচুর শক্তি এবং পুষ্টি ব্যয় করে।

সমাধান:

পাখির বাচ্চাদের জন্মের পর সারা বছর একটি পরিষ্কার পুষ্টি চার্ট বজায় রাখুন। প্রচুর শাকসবজি, ফলমূল, ক্যালসিয়াম, জিঙ্ক, অ্যামাইনো অ্যাসিড, প্রোটিন, খনিজ এবং আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ান।

সম্ভব হলে সপ্তাহে ৭ দিন আপনার পাখিকে সবজি বা ফল দিন। এবং জন্মের পর থেকে ছানাগুলি প্রথমবার ডিম দেয়ার আগ পর্যন্ত, প্রতিদিন ছোট অংশে গুঁড়ো ডিম খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হোল। কারণ এই সময়কালে পশমের শারীরিক ও কাঠামোগত বৃদ্ধি হয় শতকরা ৯০ ভাগ।

৫/ মানসিক অভ্যাস বা সমস্যা:

ই অভ্যাস বা বদ অভ্যাস অথবা মানসিক সমস্যা যেটিই বলেন এটাই হচ্ছে পাখির বাচ্চাদের ফেদার খেয়ে ফেলার বা তুলের ফেলার জন্য সবচেয়ে বড় কারন। এখানে কিছু জেনেটিক উপাদানও কাজ করে। পাখি যে কোনো কারণে তার পালক ঝরাতে শুরু করলে পাখিটি এতে অভ্যস্ত হয়ে যাবে।

এবং এই অভ্যাস পরিবর্তন করার জন্য এখনও কোন সমাধান দেখা যায়নি। এটি এমন একটি বিপজ্জনক মানসিক সমস্যা যে যদি একটি সুস্থ পাখি (অর্থাৎ যে কখনো ফেদার প্লাঙ্ক করেনি) এমন একটি পাখির সাথে যুক্ত হয় যার ফেদার প্ল্যাঙ্ক রয়েছে, তবে সুস্থ পাখিটিরও ফেদার প্ল্যাঙ্ক হতে শুরু করবে। এবং যখন শিশুটি বড় হবে, তখন সে এটির সাথে মানিয়ে নেবে।

এই সমস্যাটি সমাধান করার সঠিক উপায় কেউ জানে না বা এখনও পায়নি। এখানে কিছু পদক্ষেপ রয়েছে যা আপনি মধ্যস্থতা প্রস্তুতির প্রক্রিয়া শুরু করতে নিতে পারেন। যেমন- আপনার পাখির বাচ্চা কে ফস্টার পেয়ারের কাছে দিয়ে দেওয়া, আপনি শিশুর গায়ে ACV বা ঘৃতকুমারী লাগাতে পারেন যাতে তেতো স্বাদের কারণে এটি কামড়াতে না পারে, আপনি বাজারে চুল পড়া রোধকারী স্প্রে ব্যবহার করে দেখতে পারেন।

কিছু ভুল ধারনাঃ

 আমাদের মাঝে কিছু কমন ভুল ধারনা আছে, যেমনঃ যখন কোন পাখি ফেদার প্ল্যাঙ্ক করে, তখনই তাদেরকে ক্যালসিয়াম, জিঙ্ক, কেটেলফিসবোন (Kettle fishbones) খনিজ ব্লক (Minarel Blog) দেওয়া শুরু করেন এর পাশাপাশি পাখিদের ডিম খাওয়ানো শুরু করেন। আসলে, এই সব আমাদের ভুল বোঝাবুঝি এবং অকার্যকর সমাধান এইভাবে পাখির প্রজনন হরমোন সতেজ থাকে এবং বিপরীত ঘটার সম্ভাবনা ১০০ শতাংশ থাকে।

আর অনেকে মনে করেন আয়োডিনের কারণে পালক পড়া শুরু হয়েছে,  তাই অনেকেই পানিতে সামান্য লবণ মিশিয়ে খাওয়ানো শুরু করে, কিন্তু সেটাও কোনো কার্যকর সমাধান নয়। এটা আয়োডিনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলে লবণ পানির সমস্যা কি ৪/৫ দিনে মিটে যায়? অনেক লোক মনে করে যে আমি পাখিটিকে ৬ মাস বিশ্রাম দিয়েছি এবং প্রচুর খনিজ এবং ক্যালসিয়াম খাইয়েছি । তাহলে পাখির ফেদার প্ল্যাঙ্ক হয় কেন? এটাও একটা ভুল বোঝাবুঝি।

আর আমি আগেই বলেছি যে এইটা পাখির একটি বদ অভ্যাস আর এই বদ অভ্যাসটাই সময় মানসিক রোগে পরিণত হয়। অনেক পাখি খুব ভালোভাবে নিজের বাচ্চাদের পালে কিন্তু তাদেরও ফেদার প্ল্যাঙ্ক এর মত সমস্যা হয়। আবার অনেক পাখি আছে যারা নিজেদের বাচ্চার পশম ও খায় যখনই বাচ্চার গায়ে পশম দেখে তখনই সেই পাখি গুলো বাচ্চার গায়ে থেকে পশম তুলে খায় এতে কোন ধরণের প্রোটিন নেই তাও বদ অভ্যাস এর জন্য অনেক পাখি  এই ধরণের কাজ করে থাকে।

আরও কয়েকটি সমাধান:

 পশম অপসারণের বা ফেদার প্লাঙ্কিং এর কোনো স্থায়ী সমাধান নেই। যাইহোক, উপরেরটি ছাড়াও, খাঁচায় বাতাসের আর্দ্রতার ভারসাম্য বজায় রাখা এবং নিয়মিত আলো এবং বিশুদ্ধ বাতাসের সরবরাহ নিশ্চিত করা আপনার দায়িত্ব। পাখিটিকে একটি সঙ্গী বেছে নেওয়ার সুযোগ দিন, সবসময় খাঁচা এবং ট্রে পরিষ্কার রাখুন এবং মাঝে মাঝে পাখিদেরকে সকালের সূর্য পায় এমন জায়গা বা এমন স্থানে রাখবেন। টেমিংয়ের জন্য ছাঁটাই বাঞ্ছনীয় নয়, কারণ নতুন পালক গজানোর সাথে সাথে এটি ছিঁড়ে ফেলার সময় পাখিদের প্রায়শই শরীর চুলকায়। এবং একবার ফেদার প্ল্যাঙ্ক একটি অভ্যাস হয়ে গেলে, এটি চলতেই থাকবে। তাই পরপর দুবার পাখিদেরকে টানা প্রজনন করাবেন না, প্রতিটি মিলনের পর কমপক্ষে ২-৩ মাস বিরতি দিবেন।

ফেদার প্লাঙ্ক হওয়া বাচ্চা দের দ্রুত ফেদার তৈরি হতে টানা ১৫-২০ দিন কিছু ঔষধ ব্যবহার করতে পারেন। যেমনঃ ক্যালপ্লেক্স – ৩ মিলি + ওজিঙ্ক – ০.৫ মিলি + পেনামিন – ২ মিলি মিশিয়ে পাখিকে দিতে পারেন । এবং এর পাশাপাশি কিছু শাক – সবজি আর এগ ফুড পাখিকে খাওয়াতে হবে।

Leave a comment